রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৫:৩২ পূর্বাহ্ন
শাহাদাৎ হোসাইন:
আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা বেশ কঠিন। কেউ ভাবেনি দক্ষিণ এশিয়ার রোহিঙ্গা জেনোসাইড নিয়ে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মামলা ঠুকে দেবে। সমগ্র আরব বিশ্ব যখন গাজায় ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছে না তখন ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলের পতাকাবাহী জাহাজে হামলা করে বিশ্বে নাড়া দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য মিলেও হুতিদের দমাতে পারছে না। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান যেমন আন্দাজ করা যায়নি, তেমনি এক বছরে তাদের পতনও ছিল আশ্চর্যজনক। সৌদি আরবে মোহাম্মদ বিন সালমানের উত্থান বা ইসরায়েলে হামাসের হামলা সবটাই ছিল বিস্ময়কর। তেমনি বিস্ময়কর ইরান-পাকিস্তান সংঘাত।
ইরাক ও পাকিস্তান উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ। পশ্চিম এশিয়া ও মুসলিম বিশ্বে দেশ দুটির প্রভাব রয়েছে। পাকিস্তান যখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তখন ইরান প্রথম দেশ, যে পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ইরান ও পাকিস্তান এক সময় উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন CENTO-এর সদস্য ছিল। বর্তমানে দুই দেশই এশিয়ান ন্যাটো বলে খ্যাত নিরাপত্তা সংস্থা SCO-এর সদস্য।
ইরান-পাকিস্তানের মাঝে প্রায় ৯০০ কিলোমিটারের অস্থিতিশীল সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তে বড় আকারের আন-অফিসিয়াল বাণিজ্যও রয়েছে। সীমান্তের একদিকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশ এবং অন্যদিকে ইরানের সিস্তান ও বালুচিস্তান প্রদেশ। সিস্তান-বেলুচিস্তান ইরানের একটি প্রদেশ। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিকে ব্রিটিশ ভারতের বেলুচিস্তানকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়। যার একটি অংশ ইরানের অধীনে চলে যায়। বেলুচ সীমান্ত বহু বছর ধরে অশান্ত। অশান্ত বেলুচ অঞ্চলে উভয় দেশই দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছে। উভয়পাশের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দুই দেশের অভিন্ন শত্রু হলেও উভয়পক্ষের মাটিতে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সরাসরি হামলা চালানোর ঘটনা একটু ব্যতিক্রম। তবে দীর্ঘদিন ধরে ইরান ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে জঙ্গিদের মদদের অভিযোগ করে আসছে। ইরান অভিযোগ করছে, জাইশ-আল আদল নামক কট্টর সুন্নি গ্রুপকে পাকিস্তান অর্থায়ন করছে। ইরান দাবি করছে, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান থেকে জঙ্গিরা এসে ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে হামলা করছে। অন্যদিকে পাকিস্তানও মনে করে, বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন জোগাচ্ছে ইরানের গোয়েন্দারা। পাকিস্তান অংশে বালুচরা আলাদা একটি দেশ গঠন করতে চায়।
বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইরান-পাকিস্তান সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। ফলে পাকিস্তানের ভূখন্ডে ইরানের হামলা এবং পাকিস্তানের তীব্র প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা হামলা বিস্ময়কর বটে। সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলেও দেশ দুটির মধ্যে দীর্ঘ সময় থেকে নানা অস্বস্তি ছিল। ইরান শিয়া অধ্যুষিত। অন্যদিকে পাকিস্তানে সুন্নি মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সেখানে শিয়ারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক সবসময় একটা চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে গেছে। পাকিস্তানে একসময় সৌদি আরবের অর্থায়নকৃত ওহাবিবাদ বিস্তার লাভ করলে পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্বও দৃশ্যমান হয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ক ও পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের অবাধ বিচরণকে ইরান সবসময় সন্দেহের চোখে দেখে।
সাম্প্রতিক হামলা নিয়ে ইরান বলছে, তারা ‘পাকিস্তানি ভূখণ্ডে কেবল ইরানি সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু করেছে’ এবং কোনো পাকিস্তানি নাগরিককে লক্ষ্যবস্তু বানায়নি। অন্যদিকে, পাকিস্তান এই হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আঘাত’ বলে অভিহিত করেছে। হামলার প্রতিক্রিয়ায় তেহরানে নিজেদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয় এবং ইসলামাবাদ থেকে ইরানের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করে। পাকিস্তান পাল্টা হামলা করতেও দেরি করেনি।
ইরান ও পাকিস্তান কেন সরাসরি সংঘাতে : গত কয়েক বছর যাবৎ ইরানের বিরুদ্ধে ভেতরে এবং বাইরে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে আমেরিকা ও ইসরায়েল। ইরানের শীর্ষ কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে আমেরিকা হত্যা করেছে ইরাকের মাটিতে। অন্যদিকে ইরানের ভেতরে দেশটির শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী আহমেদ ফখরেজাদেকে হত্যা করা হয়েছে।
ইরান সরকার জনগণের কাছে নিজেদের দেশের সার্বভৌমত্ব ও নাগরিককে রক্ষা করতে পারার সক্ষমতা প্রমাণের চাপ বোধ করছে। ফলে এসব গুপ্তহত্যা রুখতে ইরান আপসহীন নীতি নিয়েছে। সে নীতির অংশ হিসেবে পাকিস্তানে ইরানবিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সরাসরি হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান।
পাকিস্তানের তীব্র প্রতিক্রিয়া আসবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। গত বছর বেলুচে দুটি জঙ্গি হামলায় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়। এই হামলার উৎপত্তিস্থল ইরানের ভেতরে ছিল বলে পাকিস্তান মনে করে। ফলে যখন ইরান সরাসরি হামলা করেছে পাকিস্তান জবাব দিতে দেরি করেনি।
বিশ্ব কী ভাবছে : পাকিস্তান ভারতের চিরশত্রু। অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছে না নয়াদিল্লির। ফলে আপাতত কোনো পক্ষে যাওয়া ভারতের জন্য খুব একটা প্রয়োজনীয় না। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের জিরো টলারেন্স অবস্থান অটুট রয়েছে। তারা বুঝতে পারছে, যে ঘটনা ঘটেছে, দেশগুলো নিজেদের আত্মরক্ষার্থে তা করেছে।’ বোঝা যাচ্ছে, বেশ কৌশলগত শব্দ উচ্চারণ করে ভারত নিরপেক্ষ থাকতে চাইছে। জইশ আল-আদল নামের যে সশস্ত্র গ্রুপকে লক্ষ্য করে ইরান হামলা চালিয়েছে, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর গ্রুপটিকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে। অন্যদিকে ইরানও যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু রাষ্ট্র। ঘটনার প্রতিক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষকে (ইরান ও পাকিস্তান) শান্ত থাকার আহ্বান জানায়।
তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার চীন। ইরান ও পাকিস্তান উভয় দেশই চীনের ঘনিষ্ঠ। পাকিস্তানে চীনের বিভিন্ন বিনিয়োগ রয়েছে এবং দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতাও বহু পুরনো। তা ছাড়া পাকিস্তান ও চীন দুই দেশ ভারতের প্রতিপক্ষ। এটিও তাদের অভিন্ন স্বার্থ। চীনের সহযোগিতায় পাকিস্তান বেলুচিস্তানে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ আহরণ ও বন্দর নির্মাণের কাজ করছে। ইরানের সঙ্গে চীনের ২৫ বছরের কৌশলগত চুক্তি হয়েছে। দেশ দুটির অভিন্ন শত্রু যুক্তরাষ্ট্র, যা সম্পর্ককে শানিত করছে। ইরানের বন্দর আব্বাস এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে গোয়াদার বন্দরের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যমে চীন তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ অংশ।
মধ্যপ্রাচ্যের চিরাচরিত ইরান ও সৌদি আরব উত্তেজনায় মধ্যস্থতা করেছে চীন। এই জটিল মধ্যস্থতায় চীন মূলত ইরানের ওপর তাদের প্রভাব প্রমাণ করেছে। ফলে কৌশলগত দুই মিত্র ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘাত চীনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখলেও চীন বসে থাকবে না।
ইরান ও পাকিস্তান কতদূর যাবে : এমন এক সময়ে এই পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, যখন গাজা যুদ্ধ ঘিরে পুরো মধ্যপ্রাচ্য এবং এর বাইরেও উত্তেজনা তীব্র বৃদ্ধি পেয়েছে।
পাকিস্তানে হামলার আগে ইরাক ও সিরিয়ায়ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। তাদের দাবি, ইসারয়েলের গোয়েন্দা ঘাঁটি লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়েছে। লেবানন সীমান্তেও ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলি বাহিনীর লড়াই চলছে। ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুতিদের সঙ্গে লড়ছে যুক্তরাষ্ট্র। গাজায় হামলার কারণে লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজে হামলা চালিয়েছে হুতি যোদ্ধারা।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকার লড়াই করছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি চরমভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। মুদ্রাস্ফীতি আকাশচুম্বী। বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগেও জনগণ যথাযথ ত্রাণ পায়নি। এমন একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি ও বিভক্ত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানও দীর্ঘ কোনো সংঘাতে যাবে বলে মনে হয় না।
ইতিমধ্যে আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক এবং উত্তেজনা প্রশমনে সম্মত হয়েছে পাকিস্তান ও ইরান। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, শুক্রবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জলিল আব্বাস জিলানি এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান ফোনে কথা বলেছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সন্ত্রাসবাদ দমন এবং পারস্পরিক উদ্বেগের অন্য দিকগুলোতে সহযোগিতা এবং ঘনিষ্ঠ সমন্বয় জোরদার করা উচিত বলে একমত হয়েছেন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ ছাড়া তারা চলমান উত্তেজনা কমাতেও সম্মত হয়েছে।’ তা ছাড়া কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে দুই দেশের রাষ্ট্রদূতদের নিজ নিজ রাজধানীতে ফেরত নিয়েও আলোচনা হয়েছে তাদের।
লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক রিসার্চ স্কলার ও কলামিস্ট
shahadat44@gmail.com
ভয়েস/আআ